আজ ওসমানীনগর সুরীকোনা গণহত্যা দিবস

১৯ জুলাই, ১৯৭১। ওসমানীনগরের সুরীকোনায় ঘটেছিল মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে জঘন্যতম নারকীয় গণহত্যা। পাকিস্থানী সেনারা হামলা চালিয়ে হত্যা করেছিল এ এলাকার অর্ধশত মানুষ। স্মরণের সে আখ্যান ঠাঁই নিয়েছে বুঝি ক্ষয়ে যাওয়া ইতিহাসে। আর তাই সুরীকোনা গণহত্যার করুণ কাহিনী অনেকের কাছেই অজ্ঞাত। এলাকার অনেকেই জানেন না শহীদদের নাম।


আজ ওসমানীনগর সুরীকোনা গণহত্যা দিবস১৮ই জুলাই, ১৯৭১। যুদ্ধে ডামাঢোলেও থেমে নেই সাধারণ মানুষের জীবন-যাত্রা। ৩দিকে নদী বেষ্টিত ওসমানীনগরের উপজেলার সাদীপুর ইউনিয়নের সুরীকোনা গ্রাম। উপজেলার বিভিন্ন জায়গা থেকে ভীত মানুষজন পাকিস্থানী বাহিনী ও রাজাকারদের হাত থেকে বাঁচতে এ গ্রামে আশ্রয় নিয়েছে। সেদিন রাতে ছিল গ্রামের জনৈক হারিছ আলীর মেয়ের বিয়ে। প্রথা অনুযায়ী তখন বিয়ের আয়োজন হতো রাতে। বিয়ে উপলক্ষে ব্যাপক লোকের সমাগম ছিল। প্রায় ৫ কিলোমিটার দূর শেরপুর পাকিস্থানী ক্যাম্পে খবর আসে সুরীকোনায় মুক্তিবাহিনী আশ্রয় নিয়েছে। হারিছ আলীর বাড়ীতে মুক্তিবাহিনীর খাবার দাবার দেওয়া হয়েছে।


এ সংবাদে ক্ষীপ্ত হয়ে উঠে দখলদার পাকিস্থানী বাহিনী। রাত ৩টার দিকে দুটো লঞ্চ যুগে শতাধিক পাকিস্থানী বাহিনী রাজাকারদের সহযোগীতায় সুরীকোনা গ্রাম ঘেরাও করে। ভোরের আযানের সাথে সাথে গ্রামের প্রায় প্রতিটা বাড়ীর দরজায় আঘাত করে তারা। প্রতিটা বাড়ীর পুরুষদের ‘মুক্তি’ সম্বোধনে ধরে এনে ৩ লাইনে দাঁড় করায়। গ্রামের উত্তরে নাটকিলা নদীর পাড়ে এক লাইন, দক্ষিন পশ্চিমে কুশিয়ারা নদীর পাড়ে দুই লাইন। সব মিলিয়ে গ্রামের প্রায় ৩০জন ও অন্যান্য এলাকা থেকে ধরে আনা আরো প্রায় ২০জন।


পাকিস্থানী বাহিনী প্রথমে সবাইকে কলেমা পড়তে বলে। কলেমা পড়া শেষ হলে নির্বিচারে গুলি ছুঁড়তে থাকে। গুলিবিদ্ধ অবস্থাতেই প্রাণ বাঁচাতে অনেকে নাটকিলা ও কুশিয়ারা নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। মুহুর্তেই নদীর পানি লাল বর্ণ ধারণ করে। আহজারীতে ভারী হয়ে উঠে পুরো এলাকা। গ্রামের মহিলারা প্রাণ ও সম্মান বাঁচাতে লুকিয়ে পড়েন বিভিন্ন স্থানে।


প্রায় ১ঘন্টা ব্যাপী পাকিস্থানী বাহিনীর তান্ডবে এলোমেলো হয়ে পড়ে পুরো সুরীকোনা  গ্রাম। গুলিবিদ্ধ অবস্থাতেই মৃত্যুর ভান করে বেঁচে যান অনেকেই তাদের মধ্যে রয়েছেন মানিক মিয়া, আতাউর রহমান, শামসুল হক। এ পর্যন্ত সে দিনের শহীদ যাদের নাম পাওয়া গেছে তারা হলেন মকরম উল্যা, মুহিব উল্যা, জহির উল্যা, আং বাহার, সুরুজ উল্যা, আং জব্বার, সাজিদ উল্যা, আফিজ উল্যা, সাইদুর রহমান, হেকিম উল্যা, ইউনুস উল্যা, তছই উল্যা, রমজান উল্যা, ছাদ উদ্দিন, বাহার উদ্দিন, সিরাজ উদ্দিন, খতিব উল্যা, তাহির উল্যা, আরফান উল্যা, তছদ্দর উল্যা, আগন উল্যা, আকবর উল্যা, জাহির উল্যা, আব্দুল কাহার, সাজিদ আলী, আফিজ আলী, সামছুল হক, আং হেকিম ও ইউনুছ উল্যা।


অনেক লাশ নদীতে ভেসে যাওয়ায় তাদের পরিচয় জানা যায়নি। পাকিস্থানী বাহিনী শেরপুরে ফিরে যাবার পর এলাকার লোকজন শহীদদের ধর্মীয় বিধানে কবর দেন।  ১৯৮০ সালের দিকে কুশিয়ারা নদীর ভাঙ্গনের শিকার হয় সুরীকোনা গ্রাম। সে সময় অনেক কবর নদী গর্ভে হারিয়ে যায়। ৯০ সালে ভাঙ্গন কবলিত এলাকায় আবার চর জেগে উঠে। কিন্তু সে কবরগুলোর কোন চিহ্ন নেই।


স্বাধীনতার ৪৫ বছর পার হয়ে গেলও সুরীকোনা গ্রামে প্রশাসনিক বা রাজনৈতিক কেউ তাদের খবর নিতে আসেনি। এমন কি দীর্ঘ অবহেলায় গ্রামের অনেকেই ভুলে গেছে গণহত্যার তারিখটিও। হতদরিদ্র দীন মজুর ও কৃষক পরিবারগুলো শহীদদের নামও বলতে পারে না। সুরীকোনা গ্রামে নেই গণকবর বা স্মৃতিস্মম্ভ। এখন অবেহেলায় পরে আছে সুরীকোনা গ্রামটি।


 

আজ ওসমানীনগর সুরীকোনা গণহত্যা দিবস

Comments

Popular posts from this blog

কুরআন ও সহীহ হাদীসের আলোকে প্রতিবেশীর হক

বাচ্চাদের কেনো ভাতের মাড় খাওয়াবেন জেনে নিন!

রোজায় সুস্থ থাকার প্রয়োজনীয় কিছু টিপস